করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় আর্থিক প্রণোদনার গুরুত্ব
=============================
গত ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে আর্বিভাব ঘটা খতরনাক সংক্রামিত বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের অপ্রতিরোধ্য আক্রমণে বাংলাদেশসহ তামাম দুনিয়ার বহু অগ্রসর দেশ সমস্যাপীড়িত আর্থিক সংকট মোকাবিলায় পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে অগণ্য মানুষের প্রাণহীন হিমশীতল মৃতদেহ, অন্যদিকে জ্যামিতিক হারে হ্রাসপ্রাপ্ত অর্থনীতির অকল্পিত দুর্দশাময় চিত্র - এই দু'টি বিমর্ষ দৃশ্য আমাদের প্রতিনিয়ত এক হতাশাবলয়ে আবদ্ধ করছে। বিষণ্ণ হৃদয়ে শুধু প্রিয়জন বিয়োগে শোকতপ্ত নয়, বরং এই অশুভ এবং বেদনাবহ পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার আপ্রাণ প্রচেষ্টা আমাদের পুনঃপুন স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যেকোন পরিস্থিতির মোকাবিলা - ২০১৫ সালে জাতিসংঘ স্বীকৃত মধ্যম আয়ের সম্ভাবনাময় অপার বৈচিত্র
্যপূর্ণ উদীয়মান অর্থনীতির দেশ - বাংলাদেশ দক্ষহাতে সুসম্পন্ন করতে সক্ষম।বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হলো রফতানি। মাইক্রো ও ম্যাক্রো অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে রফতানি অপরিহার্য।কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবমতে, ২০১৮ - ১৯ অর্থবছরে দেশের বৃহৎ দুই শিল্প পোশাক ও চামড়া খাত আয় ছিল যথাক্রমে ৩,৪১৩ ও ১০২ কোটি যা আশংকাজনক হারে ২,৭৯৫ ও ৭৯ কোটি টাকায় হ্রাসপ্রাপ্ত।
ইপিবির সমন্বিত পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে বিশ্ববাজারে ৩ হাজার ৯৫ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ৩ হাজার ৭৭৫ কোটি ৬ লাখ ডলারের পণ্য। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রফতানি কমেছে ৬৭৯ কোটি ১৪ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। অর্থাৎ ১১ মাসের হিসাবে রফতানি হ্রাস পেয়েছে ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ।অতএব,এই বিষয়টি পরিষ্কার যে, ইতিহাসের নজিরবিহীন সময় অতিক্রম করছে রফতানি। কারণ কভিড-১৯ বৈশ্বিক অর্থনীতির চিত্র পাল্টে দিয়েছে।ফলে, প্রকট হয়েছে ঘোরতর আর্থিক সংকট।এমতাবস্থায়, সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, করোনার আর্থিক সংকট দূরীকরণ ও অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করার একটি বিশুদ্ধ বহিঃপ্রকাশ। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির দৈত্যাকার ক্ষতি কাটাতে বাংলাদেশের সম্মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত পাঁচই এপ্রিল ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন।
_________________________
আর্থিক প্রণোদনা কী?
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
করোনাভাইরাসের কারণে,প্রকৃতপক্ষে, দেশের অর্থনৈতিক খাত যে ক্ষতির শিকার হয়েছে, তা কাটাতেই এই প্রণোদনা প্যাকেজ।
বিশদভাবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্যে সচল গতি আনতে, ব্যাপক উৎসাহ যোগাতে, অপূরণীয় ক্ষতি কাটাতে সহায়তা হিসাবে সরকারের তরফ থেকে যে আর্থিক প্যাকেজ বা বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়, সেটাই আর্থিক প্রণোদনা।
__________________
বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ এর টীকা - ভাষ্য =>
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
☞ মোট প্যাকেজ এর মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা।
☞ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা।
☞ রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারী দের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
☞ নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
☞ রফতানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
☞ প্রিশিপমেন্ট ঋণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
☞ গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা এবং অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা।
☞ এছাড়াও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
____________
সাধারণত ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করেই সরকারি প্রণোদনা দেয়া হয়ে থাকে।করোনাভাইরাসের ক্ষতি কাটাতে যে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলো পেতে হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হবে।
কারণ সরকার এই প্রণোদনা ঘোষণা করলেও এর বেশিরভাগটা ব্যাংক থেকে ঋণ হিসাবে দিতে হবে।পূর্বেও বিভিন্ন সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে সরকারের তরফ থেকে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এবারের মতো এত বড়ো আকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ইতিপূর্বে আর দেয়া হয়নি।
___________________
আর্থিক প্রণোদনা কেন দেয়া হয়?
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে, বেকারত্ব রোধ করতে প্রণোদনা দেয়া অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। বিশ্বের বহু দেশ তাদের জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশই প্রণোদনা প্যাকেজ সহায়তা খাতে প্রদান করছে। যেমন :-প্রতাপশালী যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার করোনা সংকট মোকাবিলায় বরাদ্দ করেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, শিল্প-কারখানার মালিক, কৃষকরা সাধারণত প্রণোদনার মূল লক্ষ্য হয়ে থাকেন। করোনাভাইরাসের ক্ষতি কাটাতে যে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই ব্যবসায়ীরা পাবেন। বলা সমীচীন যে, করোনাভাইরাস ছাড়াও সরকারের নিয়মিত কিছু প্রণোদনা রয়েছে। যেমন:- রেমিট্যান্স খাতে এখন ২ শতাংশ অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করা হচ্ছে। এটাও একপ্রকার প্রণোদনা, যার মাধ্যমে হুন্ডি বা অবৈধ উপায় এড়িয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আনতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। অনেক সময় প্রণোদনার অর্থ ফেরতযোগ্য হয়, আবার অনেক সময় হয় অফেরতযোগ্য। প্রণোদনা দেয়ার সময় এই শর্ত উল্লেখ থাকে।
_____________________________
কেমন হবে আর্থিক প্রণোদনার সুফল?
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
বলা অপ্রয়োজন যে, ফেরতযোগ্য ও অফেরতযোগ্য প্রণোদনা উভয়ই অর্থনীতিকে গতিশীল করে। কারণ এটি একদিকে যেমন ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-কারখানা চালু রাখতে সাহায্য করে, পাশাপাশি চাকরি রক্ষার মাধ্যমে, অথবা অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চার হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতি গতিশীল হয়।সার্বিকভাবে প্রণোদনা সাহায্য করে সংকট কাটিয়ে উঠতে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে একটা বড় কস্ট (মূল্য) আছে, সেটা সরকার ব্যাংক থেকেই ঋণ নিক বা বিদেশ থেকে, সেটার সুদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে, অর্থনীতির ওপর একটা চাপ আসে। তারপরেও সরকার এই চাপটা নেয়, কারণ এই মুহূর্তে মানুষকে সাহায্য করতে হবে, সাহায্য না করলে অনেকের পুঁজি নষ্ট হবে। ফলশ্রুতিতে, আগামীতেও তারা চলতে পারবে না
প্রণোদনার বেশিরভাগ সুফল ভোগ করে যারা ফর্মাল সেক্টরে একটু এগিয়ে রয়েছে, যাদের সঙ্গে ব্যাংকের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে যারা ব্যবসা করছে, ব্যাংকে বেশি লেনদেন নেই, তাদের অনেকেই এই প্রণোদনার সুফল হতে বঞ্চিত। তারা নিষ্পেষিত গোষ্ঠীর আওতাধীন হওয়াতে বেশি সুবিধে পায় না। এক্ষেত্রে সরকারকে অত্যন্ত দক্ষতা ও মানবিকতার সাথে বিষয়টির সুনির্ণীত সমাধান করতে হবে।
শেষলেখাতে বলা যায় যে, নিষ্প্রাণ অর্থনীতির প্রাণস্পন্দন ফেরাতে সরকার যে বিচক্ষণ, পরহিতৈষী ও নির্ভীক পদক্ষেপ নিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয় এবং দর্শনযোগ্য। সময়োপযোগী ও অবশ্যকরণীয় এই পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার যে ব্যবসাবান্ধব তা দিবালোকের মত স্পষ্ট এবং বলা নিষ্প্রয়োজন। তবে, এই প্রণোদনার
যথোপযুক্ত বাস্তবায়ন ও সর্বোপরি উদ্যোক্তা, ব্যবসা-বাণিজ্যের ভালো ফলাফল এবং আর্থিক তকলিফ থেকে দেশের আম আদমির যাতে নিস্তার ঘটে সেদিকে সরকারের সুনজর রাখা একান্ত আবশ্যক।

করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় আর্থিক প্রণোদনার গুরুত্ব
করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় আর্থিক প্রণোদনার গুরুত্ব