পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের কাপর তৈরি হয়। কিন্তু জামদানি শাড়ি তৈরি হয় শুধু বাংলাদেশেই। আর বিস্তারিত ভাবে বলতে গেলে বাংলাদেশের সব জায়গায় জামদানি শাড়ি তৈরি হয় না। ঢাকার আশেপাশের কয়েকটি উপজেলা ( সোনারগাঁও, তিতাবাড়ি, বাজিতপুর, ধামরাই, জঙ্গলবাড়ি প্রসিদ্ধ ছিল ) ছাড়া বোনা সম্ভব হয় না এ শাড়ি। আদিকাল থেকে ঢাকার কয়েকটি উপজেলায় এ গুণী তাঁতিদের বংশানুক্রমিক বসবাস। তাই জামদানি একান্তই ঢাকার, একান্তই বাংলাদেশের। আর এর স্বীকৃতি স্বরূপ ১৭ নভেম্বর ২০১৬ বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসাবে বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সংস্থা (WIPO) র স্বীকৃতি পায় জামদানি শাড়ি। এখন জামদানি শাড়ি আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশি পন্য, আমাদের ঐতিহ্য। এছাড়া জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা জামদানি শাড়ি বুনন শিল্পকে অধরা বা নির্বস্তুক সংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যার ফলে এখন বাংলাদেশের অধরা বা নির্বস্তুক সংস্কৃতিক ঐতিহ্য মোট চারটি মঙ্গল শোভাযাত্রা, বাংলার বাউল সংগীত, জামদানি শাড়ি এবং সর্বশেষ শীতল পাটি।
জামদানি একটি ফার্সি শব্দ ,যার অর্থ বুটিদার কাপর। সম্ভবত মুসলমানরাই জামদানির প্রচলন করেন এবং দীর্ঘদিন তাদের হাতেই এ শিল্প একচেটিয়াভাবে সীমাবদ্ধ থাকে। জামদানির উল্লেখ পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্র গ্রন্থে, চর্যাপদের বিভিন্ন পংক্তিতে, এবং বাংলা ভ্রমন করা বিভিন্ন পরিব্রাজকের লেখায়। ঐতিহাসিক আবুল ফজল সোনারগাঁয়ে প্রস্ত্ততকৃত মসলিনের প্রশংসা করেছেন। জামদানি শিল্পকর্ম পরিপূর্ণতা লাভ করে মুগল আমলে। ঢাকা জেলার প্রত্যেক গ্রামেই তখন কমবেশি তাঁতের কাজ হতো। জামদানি বলতে সাধারণত শাড়ি বোঝানো হলেও প্রকৃতপক্ষে ঐতিহ্যবাহী নকশায় সমৃদ্ধ ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, ঘাগরা, রুমাল, পর্দা, টেবিল ক্লথ সবই জামদানির আওতায় পড়ে।
জামদানি শাড়ির বুনন কৌশল এর নিজেস্ব এবং জটিল। বংশ পরাম্পরায় তৈরি হয় জামদানি শাড়ির কারিগর। প্রতি শাড়ি তৈরি করতে দু জন তাঁতি দিনের পর দিন কাজ করে যায়। এক একটা শাড়ি ১১ থেকে ১৩ হাতের মধ্যে হয়ে থাকে। ডিজাইন ভেদে একটি শাড়ি তৈরি করতে ৭ দিন থকে ৬ মাস পর্যন্ত লাগতে পারে। তাই এর দামও অনেক বেশি হয়ে থাকে। হাতে বুনা আসল জামদানির দাম তিন হাজার থেকে এক লক্ষ বিশ হাজার বা তার বেশি হয়ে থাকে। তবে মেশিনে বুনা জামদানির কথা আলাদা।
| জামদানি শাড়ি বুনন |
জামদানি শাড়ি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। বাংলার ঐতিহ্য জামদানি শাড়ি বুনন কৌশলের উপর ভিত্তি করে দুই রকম।
- হাতের তাঁতে বুনা জামদানি - হাতের তাঁতে বুনা জামদানি হল বাংলাদেশে সে ঐতিহ্যবাহী জামদানি। এখানে জামদানি বুনন শীল্পের কারিগররা তাদের নিপুন হাতের ছোঁয়ায় সব কাজ করে। সুতা কাটা থেকে শুরু করে শাড়ি তৈরি হওয়া সব কাজ হয় আধুনিক যন্ত্রের ব্যাবহার ছাড়া। যার ফলে তাঁতে তৈরি জামদানির কদর থাকে আলাদা দাম হয় বেশি।
- মেশিনে বুনা জামদানি - বর্তামানে আধুনিক অটোমেটিক মেশিনেও জামদানি শাড়ি তৈরি হচ্ছে। যার ফলে এখন জামদানি শাড়ির দাম কমে গেছে। কিন্তু তাঁতে বুনা শাড়ি আর মেশিনে বুনা শাড়ির প্রার্থক্য অনেক।
আবার সুতার উপর ভিত্তি করে জামদানি শাড়ি তিন রকমের হয়।
- ফুল কটন জামদানি - যেটা তুলার সূতা দিয়ে তৈরি করা হয়। ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি আসলে তাঁতে তৈরি এই ফুল কটন জামদানি শাড়ি।যেটা গুনে ও মানে অনন্য।
- হাফ সিল্ক জামদানি শাড়ি - যেখানে আড়াআড়ি সুতাগুলো হয় রেশমের আর লম্বালম্বি সূতাগুলো হয় তুলার। অর্ধেক কর্টন আর অর্ধক তুলার সুতা।
- ফুল-সিল্ক জামদানি - যেখানে দুই প্রান্তের সূতাই রেশমের হয়ে থাকে।
জামদানির বৈশিষ্ট্য - জামদানি শাড়ির আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যা জামদানি কে করেছে বিশিষ্ট ,আলাদা ও অনন্য।
- জামদানির প্রধান বৈশিষ্ট্য এর জ্যামিতিক নকশা। এই জ্যামিতিক নকশায় ফুটিয়ে তোলা হয় নানা ধরণের ফুল, লতাপাতা, পাখি সহ নানা ডিজাইন।
- জামদানির ডিজাইন বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। তারমধ্যে পান্না হাজার, তেরছা, পানসি, ময়ূরপঙ্খী, বটপাতা, করলা, জাল, বুটিদার, জলপাড়, দুবলি, ডুরিয়া, বলিহার, কটিহার, কলকাপাড় ইত্যাদি বেশি প্রচলিত।
- জামদানিতে ছোট ছোট ফুল বা লতাপাতার ডিজাইন যদি তেরছা ভাবে সারিবদ্ধ থাকে, তাহলে তাকে তেরছা জামদানি বলে।
- ফুল, লতার বুটি জাল বুননের মতো সমস্ত জমিনে থাকলে তাকে জালার নকশা বলা হয়।
- পুরো জমিনে সারিবদ্ধ ফুলকাটা জামদানি ফুলওয়ার নামে পরিচিত। ডুরিয়া জামদানি ডোরাকাটা নকশায় সাজানো থাকে।
- তেমনি পাড়ে কলকির নকশা থাকলে তা হবে কলকাপাড়।
জামদানি আমাদের ঐতিহ্য হলে ইংরেজ শাসন আমালে জামদানি বুনন শিল্প প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৮ সালে জামদানি শিল্পকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করে ব্রাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও তার প্রতিষ্ঠান আড়ং। তাদের চেষ্টায় শাড়ি তৈরি হয় এবং ১৯৮১ সালে একটি প্রদর্শনী হয় শিল্পকলা একাডেমীতে। যার ফলে সবাই আবার জামদানির কদর বুঝতে পারে। এর পর থেকে জামদানি শিল্প আবার উঠে দাঁড়াতে শুরু করে। শুরু হয় নতুন পথ চলা। এখনো বাঙালি নারীদের প্রথম পছন্দের শাড়ি জামদানি শাড়ি। বিয়েতে জামদানি শাড়ি ছাড়া যেন চলেই না।
এক সময় হারিয়ে যওয়া জামদানি শাড়ি আজ ফিরে এসেছে। পেয়েছে ইউনেস্কোর অধরা সংস্কৃতির মর্যাদা এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশিক পণ্যের স্বীকৃতি। আমরা যদি এটা কি ঠিক মত তুলে ধরতে পারি আমাদের জামদানি আবার তার বিশ্ব ঐতিহ্য ফিরে পাবে। সারা বিশ্বে আমরা নতুন করে পরিচিত হতে পারবো জামদানি শাড়ি দিয়ে।

0 Comments